গুমের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন এবং পঞ্চাশ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রেখে গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। খসড়ায় গুমের শিকার ব্যক্তির মৃত্যু হলে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গুমের মত ঘৃণ্য অপরাধের বিচার হবে ট্রাইব্যুনালে। যা গুম প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনাল নামে অভিহিত হবে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশের এই খসড়া প্রস্তুত করেছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, গুমের অপরাধ আমলযোগ্য, জামিন অযোগ্য এবং আপস-অযোগ্য হবে। দণ্ড ঘোষণার ১৪ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে অর্থদণ্ড জমা দিতে হবে দণ্ডিত ব্যক্তিকে। অর্থদণ্ড জমা না দিলে তিনি সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন না। এছাড়া আদালত কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে, অপরাধীর স্থাবর-অস্থাবর বা উভয়বিধ সম্পত্তির তালিকা প্রস্তুত করে ক্রোক ও নিলাম বা ক্রোক ছাড়াই সরাসরি নিলামে বিক্রয় করে বিক্রয়লদ্ধ অর্থ আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী অথবা রাষ্ট্র বা কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, সমর্থন বা মৌন সম্মতির বলে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যদি কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, আটক, অপহরণ অথবা অন্য যে কোনভাবে স্বাধীনতা হরণ করেন এবং সেই ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করার বিষয়টি অস্বীকার করে অথবা ঐ ব্যক্তির নিয়তি বা অবস্থান গোপন রাখে-যার ফলে ঐ ব্যক্তি আইনগত সুরক্ষার বাইরে অবস্থান করে তাহলে এ সংক্রান্ত কাজ হবে একটি অপরাধ। যা গুম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে খসড়ায়। এ ধরনের গুমের অপরাধ সংঘটনে কেউ উদ্যোগী হন, সংঘটনে নির্দেশ, সহায়তা বা প্ররোচনা দেন অথবা সংঘটনে ষড়যন্ত্র করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি মূল অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তা যদি এমন কোন তথ্য জানেন, অথবা সচেতনভাবে উপেক্ষা করেন যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে তার কার্যকর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণাধীন অধস্তন কোনো ব্যক্তি গুমের অপরাধ করতেছেন বা করতে যাচ্ছেন-এমন তথ্য জানার পরেও যদি যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা না নেন তাহলে তিনিও গুমের অপরাধে দণ্ডিত হবেন।
গঠিত হবে জাতীয় গুম প্রতিরোধ কমিশন :খসড়ায় বলা হয়েছে, অধ্যাদেশ জারি পর সরকার জাতীয় গুম প্রতিরোধ কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করবে। কমিশনের কাজ হবে গুম সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত পরিচালনা করা। দেশের যে কোন কারাগার, হাজতখানা ও আটককেন্দ্র সরেজমিন পরিদর্শন করতে পারবে কমিশন। গুম প্রতিরোধ ও দমনের উদ্দেশ্যে নিজস্ব জনবল, শৃঙ্খলা বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচারকদের জন্য প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা করবে। গুমের শিকার ব্যক্তি কিংবা তার পরিবারের নিকট হতে এ সংক্রান্ত ঘটনার বর্ণনা রেকর্ড করবে। এছাড়া গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার স্বজনদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা, কর্তব্য গাফিলতির ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নজরে আনতে পারবে কমিশন। কমিশন গঠন না হওয়া পর্যন্ত এর যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পালন করবে।
অভিযোগ দাখিল ও আমলে নেয়া :খসড়ায় বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের অধীন কোন অপরাধের ভিকটিম বা তার কোন আত্মীয়ের অভিযোগ, পুলিশ প্রতিবেদন ও কমিশনের প্রতিবেদন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আমলে নিতে পারবে। গুমের অপরাধের তদন্ত পরিচালনার জন্য যে কোন মামলা কমিশনে পাঠানোর ক্ষমা দেয়া হয়েছে। সরকার গুমের অপরাধ তদন্তের জন্য বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা গঠন করতে পারবে। তবে কোন সরকারি কর্মচারী গুমের অপরাধে জড়িত হলে সেই কর্মচারীর প্রতিষ্ঠানের কোন ব্যক্তি অভিযোগের তদন্ত করতে পারবে না।
প্রসঙ্গত গত দেড় দশকে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য দ্বারা অসংখ্য মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকার গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক দেশে জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান ও সনাক্ত করা এবং কোন পরিস্থিতিতে তারা গুমের শিকার হয়েছিলেন তা খুঁজে বের করতে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে দেন। ওই কমিশনের গুমের শিকার হাজার পরিবার অভিযোগ দাখিল করেন। সেসব অভিযোগ তদন্ত করে কমিশন বলেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এসব গুমের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি গুমের শিকার অনেক ব্যক্তি ফিরে আসলেও অনেকের হদিস এখনো মিলে নাই। তবে অস্তিত্ব মিলেছে আয়নাঘরের।